Dr. Neem on Daraz
Victory Day
উন্নয়নে কাজ করছে বিএফআরআই

অপ্রচলিত জলজ সম্পদের বাণিজ্যিক চাষাবাদের ব্যাপক সম্ভাবনা 


আগামী নিউজ | তরিকুল ইসলাম সুমন প্রকাশিত: জুলাই ১৫, ২০২০, ০৩:১৬ পিএম
অপ্রচলিত জলজ সম্পদের বাণিজ্যিক চাষাবাদের ব্যাপক সম্ভাবনা 

ছবি সংগৃহীত

ঢাকা: ক্রমবর্ধমান মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণে নানা ধরণের বৈচিত্র খাবার শোভা পাচ্ছে খাবারের টেবিলে। খাবারের চাহিদা পূরণে মাটিতে চাষাবাদের মতো করে পনিতেও চাষাবাদ হচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না নোনা পানিও। আর আমাদরে দেশের প্রেক্ষাপটে আমাদের চাহিদা কম থাকলেও বিদেশে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এমন অনেক অপ্রচলিত খাবার নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনষ্টিটিউট (বিএফআরআই)।

সরকারের এ প্রতিষ্ঠানটি মাছের পাশাপাশি জলজ সম্পদ নিয়েও বিস্তর কাজ করছে। এখন তারা স্বাদু পানির পাশাপাশি সুবিশাল ব্লু ইকোনমি নিয়েও কাজ করছে। বর্তমানে দেশে কম প্রচলিত কিন্তু বিদেশে প্রচুর চাহিদা রয়েছে এ রকম খাদ্য উপকরণ নিয়ে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন (বিএফআরআই) এর মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ।

ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ আগামীনিউজ ডটকমকে বলেন, Blue Sea Economy বা নীল সমুদ্র অর্থনীতির বিভিন্ন সম্পদ নিয়ে আমরা কাজ করছি। মৎস্য সম্পদের পাশাপাশি বিভিন্ন সি-উইডস তথা সমুদ্র শৈবাল, কুচিয়া, কাঁকড়া, ঝিনুক-শামুক এবং কচ্ছপের বাণিজ্যিক চাষাবাদ নিয়ে গবেষণা চলছে।

সি-উইডস বা সামুদ্রিক আগাছা: স্বাদ, গুন ও পুষ্টিমানে ভরপুর এ খাদ্য পৃথিবীর অনেক দেশে ব্যাপক পরিচিত হলেও নানা প্রতিকূলতার কারণে বাংলাদেশে নেই এর পরিচিতি ও প্রচারণা।

পুষ্টিবিদদের মতে, এই সিউইড সংযোজন যে কোনো ধরনের খাবারকে সুস্বাদু তো বটেই-এর পুষ্টিগুণও বাড়িয়ে দিতে পারে অনেক। অজ্ঞতাই যে এই নির্লিপ্ততার কারণ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সমুদ্রসীমা জয় করা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে সিউইড তথা সমুদ্র শৈবাল। শুধু খাদ্য তালিকায় নয়, প্রসাধনী ও ডেকোরেশন- এই তিন আঙ্গিকে এর ব্যবহার বহির্বিশ্বে বেশ মর্যাদার বলে বিবেচিত। সিউইড পণ্য মিয়ানমারের অন্যতম একটি রফতানি পণ্য। অথচ বাংলাদেশের জলসীমার সিউইড মানের দিক দিয়ে বিশ্বের এক নম্বরে।

কচ্ছপ: এটি মাংসাশী ও তৃণভোজী উভচর জাতীয় প্রাণী। মানুষের খাদ্য হিসাবে কচ্ছপের ব্যবহার দিন দিন বাড়তে থাকায় অতিরিক্ত আহরণ ও পরিবেশের বিপর্যয়ের দরুন বাংলাদেশে কচ্ছপের জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির সম্মুখীন। তাছাড়াও কচ্ছপ রপ্তানী পণ্য বিধায় প্রতি বছর এর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। পৃথিবীতে কচ্ছপের ৩৪০টি প্রজাতি রয়েছে যাদের ভৌগোলিক বিস্তৃতি অত্যন্ত ব্যাপক। বাংলাদেশে প্রায় ২৫ প্রজাতির কচ্ছপ রয়েছে। তবে এদের মধ্যে ১১টি প্রজাতি মানুষের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয় যার ৪ টি বিদেশে রপ্তানী করা যায়। বাংলাদেশে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে (রুফড টার্টল বা মাজহারি কাইট্টা, স্পটেড ফ্ল্যাপ-শেল টার্টল বা শুনধি কাসিম, পিক্ক সফ্ট শেল টার্টল বা ধুম কাসিম এবং এশিয়াটিক সফ্ট শেল টার্টল বা সিম কাসিম)

বাংলাদেশে কচ্ছপ চাষের কলাকৌশল উন্নয়ন সম্পর্কিত গবেষণা এখনও তেমন পরিচালিত হয়নি। ফলে কচ্ছপের বাণিজ্যক উৎপাদন এবং মুনাফা সম্পর্কিত তথ্যাদি অত্যন্ত অপ্রতুল। উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নরম খোলসধারী কচ্ছপ চাষকালে বছরে এদের দেহের ওজন ৫০০-৬০০ গ্রাম হয়ে থাকে।

বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কচ্ছপ চাষ অনেকাংশে কৃত্রিম উপায়ে উৎপাদিত বাচ্চা ও সম্পূরক খাদ্যের উপর নির্ভরশীল। তাই এ চাষ ব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে কচ্ছপের কৃত্রিম প্রজনন, ব্যাপক পোনা উৎপাদন ও সম্পূরক খাদ্য তৈরীর কৌশল বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন। প্রাকৃতিক পরিবেশে কচ্ছপের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের নিমিত্ত জাতীয় পর্যায়ে টাস্ক ফোর্স গঠন বা এ জাতীয় অন্য কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।

কুঁচিয়া: সাপের মতো দেখতে হলেও কুঁচিয়া এক প্রকার মাছ। ইহা বাংলাদেশে কুইচ্চা, কুঁইচা, কুঁচে, কুঁচো ইত্যাদি নামে পরিচিত। বাংলাদেশের হাওর, বাওড়, খাল-বিল, পচা পুকুর, ধানক্ষেতে এবং বন্যাপ্লাবিত অঞ্চলে কুঁচিয়া মাছ দেখতে পাওয়া যায়। কুঁচিয়া মাছের শরীর লম্বা বেলনাকৃতির। আপাতদৃষ্টিতে কুঁচিয়া মাছকে আঁশবিহীন মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে ইহার গায়ে ক্ষুদ্রাকৃতির আঁশ বিদ্যমান যার বেশিরভাগ অংশই চামড়ার নিচে সজ্জিত থাকে।

খাদ্য হিসেবে কিছু কিছু উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয় হলেও বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ কুঁচিয়া মাছকে অস্পৃর্শ মনে করে। যদিও ইহা শারীরিক দুর্বলতা, রক্তশূন্যতা, অ্যাজমা রোগ, ডায়াবেটিস, বাতজ্বর, পাইলসসহ অনেক রোগ সারাতে মহৌওষুধের মতো কাজ করে। তাছাড়া পরিবেশের খাদ্য জালে কুঁচিয়ার অনন্য অবদান রয়েছে। ধান ক্ষেতের ফসল অনিষ্টকারী পোকার লার্ভা, শামুক, কৃমি ইত্যাদি খেয়ে কুঁচিয়া কৃষকের উপকারী বন্ধু হিসেবে কাজ করে। অনেক পচা-গলা জৈবপদার্থ খেয়ে পরিবেশে মানবসমাজের বিশেষ বন্ধু হিসেবে ভূমিকা রাখে।

তথ্য মতে, শুধুমাত্র ২০১৩-১৪ সালে জীবিত মাছ হিসেবে ৭,০১৭৫ টন কুঁচিয়া বিদেশে রফতানি করে বাংলাদেশ প্রায় ১.৫ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে।

ঝিনুক ও শামুক: বিদেশ ও দেশীয় বাজারে ব্যপক চাহিদা থাকায় 'বাংলাদেশে ঝিনুক ও শামুক সংরক্ষণ, পোনা উৎপাদন এবং চাষ প্রকল্প' শুরু হয়েছে। ময়মনসিংহ, গোপালগঞ্জ, কক্সবাজার, চাঁদপুর, বগুড়া, যশোর ও বাগেরহাটে গবেষণা চলছে। 
অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ঝিনুক ও শামুকের পোনা উৎপাদন ও চাষ প্রযুক্তির উদ্ভাবন, বাংলাদেশে ঝিনুক ও শামুকের পপুলেশন ডিনামিক্স এর উপর বেইজ-লাইন তৈরী, ঝিনুক ও শামুক সংরক্ষণের জন্য সচেতনতা তৈরী এবং প্রযুক্তি ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান।

বাংলাদেশের স্বাদপানি ও লোনাপানিতে ১৬ প্রজাতির ঝিনুক পাওয়া যায়। ঝিনুকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার হলো মুক্তা তৈরী। ঝিনুকের খোলস থেকে চুন তৈরী এবং ঝিনুকের মাসল অংশ হাঁস-মুরগীর খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিশ্বের অনেক দেশে ঝিনুকের মাংসল অংশ প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে সাধারণত আদিবাসী জনগোষ্ঠীরা ঝিনুকের মাংসল অংশ খেয়ে থাকে। সামুদ্রিক ঝিনুক (ওয়েস্টার) একটি দামি সীফুড হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং অনেক দেশে এর উপর ভিত্তি করে খামার গড়ে উঠেছে। 

১৯৯০ এর দশকে ভারতে সামুদ্রিক ঝিনুকের বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয়েছে। মানুষ ও জলজ পরিবেশ উভয়ের জন্য ঝিনুক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জলাশয় থেকে শৈবাল, জৈব পদার্থ এবং দ্রবীভূত ক্ষতিকারক উপাদান যেমন- ভারী ধাতু দূরীকরণে ঝিনুকের ভূমিকা রয়েছে। এইভাবে ঝিনুক প্রাকৃতিক পানি পরিষ্কারক হিসেবে কাজ করে। জলজ খাদ্য শৃঙ্খলের ক্ষেত্রে ঝিনুক একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং এরা জলজ খাদ্য শিকলের বিভিন্ন লেভের সাথে সংযোগ স্থাপন করে। দেশের বিভিন্ন জলাশয়ে ঝিনুক চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।

অপরদিকে, দেশের বিভিন্ন জলরাশি যেমন পুকুর, খাল, বিল, হাওর ও বাওরে প্রায় ৪৫০ প্রজাতির শামুক পাওয়া যায়। এ মধ্যে Pila globosa (আপেল শামুক) ও Viviparus bengalensis (পন্ড স্নেইল) ব্যাপক মাত্রায় পাওয়া যায়। 

শামুকের ব্যাপক অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত গুরুত্ব রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ শামুকের মাংস খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করে থাকে। সাধারণত কিছু আদিবাসী ভিন্ন বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ শামুকের মাংস খাদ্য হিসেবে গ্রহণে অভ্যস্থ নয়। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে গলদা চিংড়ির খাদ্য হিসাবে দিনে প্রায় গড়ে ৬৬.৫ কেজি/হেক্টর শামুকের মাংস ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলোয় বসবাসরত উপজাতী জনগোষ্ঠিরা ক্ষুদ্র পরিসরে শামুকের চাষ করছে।

কাঁকড়া: দেশে আশির দশক থেকে রফতানি পণ্য হিসেবে চাষাবাদ করা হচ্ছে। উপকূলের ৪৮০ কিলোমিটার এলাকায় লোনাপানিতে ১২ প্রজাতির কাঁকড়া দেখতে পাওয়া গেলেও শিলা কাঁকড়ার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে,  সুন্দরবন এলাকা থেকে বর্তমানে প্রতিবছর ৩৭৫ টন কাঁকড়া রফতানি হয়ে থাকে। এটি বানিজ্যিকভাবে চাষাবাদে ৩-৪ মাসের মধ্যেই বিক্রির উপযোগী হয়ে ওঠে।

আগামীনিউজ/টিআইএস/এমআর 

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে